বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০৯:৫৪ অপরাহ্ন

হত্যা-গণধর্ষণ-মানুষ চাপা সবই ‘আশুলিয়া ক্লাসিক’ পরিবহনে!

হত্যা-গণধর্ষণ-মানুষ চাপা সবই ‘আশুলিয়া ক্লাসিক’ পরিবহনে!

স্বদেশ ডেস্ক:

ঢাকা জেলার আশুলিয়ার নরসিংপুর এলাকা। গত ১১ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে ওই এলাকা দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজ বাসায় ফিরছিলেন শামছুল আলম (৪৫) নামের এক ব্যক্তি। তিনি স্থানীয় ‘শারমিন গার্মেন্টস’-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা।

সারা দিন অফিস শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার, কারণ ‘ভুল পথে’ গিয়ে তাকে বাস চাপা দিয়েছেন এক নেশাগ্রস্ত চালক। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় শামছুল আলমের।

শামছুল আলমকে চাপা দিয়ে প্রায় ১ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে গিয়ে জনতার চাপে বাসটি ফেলে পালিয়ে যান বাসচালক ও হেলপার। বাসটি জব্দ করে স্থানীয় থানা পুলিশ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, শামছুল আলমকে চাপা দেওয়া ওই বাসটির নাম ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহন’। শুধু মাত্র শামছুল আলমের প্রাণই কেড়ে নেয়নি এই বাস, এর আগেও একজনের মরদেহ পাওয়া গেছে ওই বাসের ভেতরে। এক তরুণীকে ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছিল ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনে’। এছাড়া, এক তরুণীকে গণ-ধর্ষণ করার অভিযোগও রয়েছে এই ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনে’র বিরুদ্ধে।

১১ মার্চের ওই ঘটনার পরে বিক্ষুব্ধ জনতা ঢাকা বাইপাইল সড়ক অবরোধ করে অন্তত ২০-২৫টি বাস ভাঙচুরসহ প্রায় পাঁচটি বাসে অগ্নিসংযোগ ঘটায়। উত্তেজিত জনতা উক্ত বাসের ড্রাইভার ও হেল্পারকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ঢাকা-বাইপাইল সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করে। পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পলাতক আসামিদেরকে দ্রুত গ্রেপ্তারের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার আশ্বাস দিলে উত্তেজিত জনতা আন্দোলন স্থগিত করে রাস্তা অবরোধ তুলে নেয়।

যেভাবে চাপা দেওয়া হয় শামছুল আলমকে

আশুলিয়ার নরসিংপুর এলাকার একটি ভবনে থাকা সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিটে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছিল ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনের’ একটি বাস। এর কয়েক সেকেন্ড পরেই পেছন থেকে দ্রুত গতিতে আসতে দেখা যায় ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনেরই’ আরও একটি বাসকে। সেই বাসটিতেও যাত্রী উঠনোর রেষারেষিতে কয়েক সেকেন্ড পরেই বাসটি দ্রুত গতিতে চলে যায়।

বাসটি ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত গতিতে চলে যাওয়ার পরেই সড়কে একজনকে পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। এরপর ওই বাসটিকে ধাওয়া করেন উত্তেজিত জনতা। ঘটনাস্থলে পড়ে থাকা ওই ব্যক্তিই হলেন নিহত শামছুল আলম। ‘রং সাইডে’ গিয়ে তাকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহন’।

গ্রেপ্তার হওয়া বাস চালক ও হেল্পার

যেভাবে গ্রেপ্তার হয় সেই চালক-হেল্পার

গার্মেন্টস কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে চাপা দেওয়ার ঘটনায় পলাতক দুইজন আসামিকে গতকাল শনিবার গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৪।

র‍্যাব সূত্রে জানা যায়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল সাভার মডেল থানার জামতলা এলাকায় গতকাল রাতে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে পলাতক বাসচালক মো. ওয়াসিম ওরফে আল-আমিন (২৫) ও হেল্পার মো. শাকিলকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা উক্ত গার্মেন্টস কর্মকর্তাকে বাস চাপা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।

চাপা দেওয়ার বিষয়ে ড্রাইভার-হেলপারে বক্তব্য

গ্রেপ্তার হওয়া উক্ত বাসের চালক মো. ওয়াসিম ওরফে আল-আমিনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব জানায়, সে আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনের একজন বাস ড্রাইভার। ঘটনার দিন সে বাসটি চালিয়ে নরসিংপুর এলাকায় পৌঁছালে সামনে থাকা অপর একটি ক্লাসিক পরিবহনের বাসকে ওভারটেক করার সময় তাদের বাস কর্তৃক মোটরসাইকেল আরোহী গার্মেন্টস কর্মকর্তা মো. শামছুল আলমকে চাপা দেওয়া হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে ওই চালক আরও জানায় যে, তার কোনো নিজস্ব ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই এবং ঘটনার দিন সে বিভিন্ন প্রকার নেশায় আসক্ত ছিল।

এদিকে গ্রেপ্তার হেল্পার শাকিলকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব জানায় যে, সে আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনের একজন নিয়মিত হেলপার। ঘটনার দিন সে ড্রাইভার ওয়াসিমের সঙ্গে হেলপার হিসেবে ডিউটিরত অবস্থায় ছিল। কিন্তু ঘটনার সময়ে সে মোটরসাইকেল আরোহী গার্মেন্টস কর্মকর্তা শামছুল আলমকে দেখেও না দেখার ভান করে ড্রাইভারকে সামনে এগিয়ে যেতে বলে। যার ফলে ঘটনাস্থলেই গার্মেন্টস কর্মকর্তা নিহত হন।

নেই রুট পারমিট-ফিটনেস সার্টিফিকেটও

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জব্দ করা ওই বাসটির রুট পারমিট শেষ হয়েছে গত ৩১ জানুয়ারি। বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরের ২৬ মার্চ। এছাড়াও গত ৩১ জানুয়ারি ২০২০ তারিখের পর এই বাসটির ট্যাক্স টোকেন আপডেট করা হয়নি।

আরও যত অঘটন ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনে’

র‍্যাব ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের মার্চ মাসে একজন তরুণীকে ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহন’ এর বাসে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগের চাঞ্চল্যকর মামলায় বাসের চালক-হেলপারসহ মোট তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছিল র‍্যাব। পরবর্তীতে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহন’-এর ভেতর এক তরুণীকে গণ-ধর্ষণের অভিযোগে আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। পরে সেই মামলায় পুলিশ বাসের চালক-হেলপারসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

এছাড়াও, ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই  হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডে শিকার এক যুবকের মরদেহ এই ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনের’ একটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয়।

এই বিষয়ে র‍্যাব-৪ এর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. জিয়াউর রহমান বলেন, ‘সাভার মডেল থানার জামতলা এলাকায় গতকাল রাতে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে পলাতক ড্রাইভার মো. ওয়াসিম ওরফে আল-আমিন (২৫) ও হেল্পার মো. শাকিলকে (২৮) গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের আশুলিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।’

এই বিষয়ে কথা বলতে ‘আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনের’ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কাউকেও পাওয়া যায়নি।

জবাব দিহিতার আওতায় আসতে হবে

এই ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল বলেন, ‘আসলে এর আগেও আমরা দেখেছি যে দুই বাসের রেষারেষির কারণে দুইজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিল। এরপরও আমরা দেখেছি ওই বাসটি অন্য নামে রং পাল্টিয়ে আবারও সড়কে নেমেছে।’

তিনি বলেন, ‘এই “আশুলিয়া ক্লাসিক পরিবহনের” মধ্যে একাধিক বড় বড় ঘটনা ঘটেছে। সেই গাড়ির নেই কোনো কাগজপত্র। তাদের রুট পারমিট শেষ হয়েছে গত ৩১ জানুয়ারি। বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছরে। তো এভাবেই কেমনে বাসটি সড়কে এত দিন চলছে সেটাই তো প্রশ্ন। ’

কেফায়েত শাকিল আরও বলেন, ‘আসলে আমাদের রোড ট্রান্সপোর্ট অর্থরিটি তারা কি এসব দেখে না। তারা দেখভাল করলে কীভাবে এই বাসগুলো সড়কে চলতে পারে। কাজেই এই সংস্থাগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। তারা আন্তরিকতার সহিত কাজ করলেই আসলে সড়কে এমন মৃত্যুর মিছিল কমে আসবে বলে আমরা মনে করি।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877